Ads Here

Wednesday, April 15, 2020

তবে কি ২৯ এপ্রিল ধ্বংস হতে চলছে পৃথিবী?




জ্ঞান বিজ্ঞানের চর্চায় মানুষ আধুনিকতার শীর্ষে পৌছালেও, প্রাকৃতিক বিপর্যয় ঠেকানো মানুষের পক্ষে কিছুতেই সম্ভব নয়। বিভিন্ন অনলাইন মাধ্যমে ফলাও করে প্রচার করা হচ্ছে আগামী ২৯ এপ্রিল ২০২০ তারিখে, একটি বিশাল গ্রহাণুর আঘাতে পৃথিবী ধ্বংস হয়ে যাবে। সত্যিই কি এরকম কোন গ্রহাণু পৃথিবীতে আছড়ে পড়বে? আর গ্রহাণুটি পৃথিবীতে আঘাত হানলেও, পৃথিবীর ধ্বংস হবার সম্ভাবনা কতটুকু ??


আলোচনা শুরু করার আগে আমাদের জানতে হবে, গ্রহাণু কি ? গ্রহাণু বা Asteriod হলো, পাথর বা খনিজ  পদার্থের দ্বারা গঠিত এমন বস্তু যা সূর্যের মতো বিভিন্ন তারকাকে কেন্দ্র করে প্রদক্ষিণ করে। গ্রহাণু অতি ক্ষুদ্র থেকে বৃহৎ বিভিন্ন আকারের হতে পারে। এমনকি বিভিন্ন
গ্রহাণুর আবার উপগ্রহাণু থাকে। চাঁদ যেমন পৃথিবীকে কেন্দ্র প্রদক্ষিণ করে ঠিক তেমনি বড় গ্রহাণুগুলোর চারপাশে ছোট ছোট গ্রহাণু প্রদক্ষিণ করতে পারে। বেশিরভাগ গ্রহাণুই এবড়োথেবড়ো এবং অনিয়মিত আকৃতির হয়ে থাকে।  কোনো গ্রহানুরই নিজস্ব আবহাওয়া বা বায়ুমণ্ডল নেই এবং ভূ-তাত্ত্বিক ভাবে সক্রিয় নয়। আমাদের সৌরজগতে বহু গ্রহাণু রয়েছে, বেশিরভাগ গ্রহাণু মঙ্গলগ্রহ এবং জুপিটারগ্রহের মধ্যবর্তী অঞ্চল দিয়ে সূর্যকে প্রদক্ষিণ করে তাই এই অংশকে বলা হয় "এস্টেরয়েড বেল্ট"(Asteroid Belt) এস্টেরয়েড বেল্টে থাকা সকল গ্রহাণুর সম্মিলিত ভর আমাদের চাঁদের ভরের সমান। এস্টেরয়েড বেল্টের বাইরে থাকা বাইরে থাকা যেসমস্ত গ্রহাণু পৃথিবীর খুব কাছ দিয়ে প্রদক্ষিণ করে তাদেরকে বলা হয় Near Earth Asteroid মহাকাশ গবেষকেরা পর্যবেক্ষণ করে দেখেছেন প্রায় সাড়ে হাজার গ্রহাণু আমাদের পৃথিবীর খুব কাছ দিয়ে প্রদক্ষিণ করে। যাদের মধ্যে প্রায় হাজার গ্রহাণুর ব্যাস কিলোমিটার। প্রতি বছরই প্রায় ১০-৩০ ফুট ব্যাসের গ্রহাণু আমাদের পৃথিবীতে আছড়ে পড়ে। আকারে তুলনামূলক ছোট হওয়ায় সেসব আঘাতে পৃথিবীর তেমন কোনো ক্ষতি হয় না। কিন্তু অতীতে বড় বড় গ্রহাণুর আঘাতে সমগ্র পৃথিবী জুড়ে বিরাট পরিবর্তন সাধিত হয়েছে। সর্বশেষ সবচেয়ে বড় গ্রহাণুর আঘাতে পৃথিবী থেকে ডাইনোসর বিলুপ্ত হয়ে গেছে। আবারো বড় কোনো গ্রহাণুর পৃথিবীতে আঘাত হানার সম্ভাবনা আছে কিনা তা জানতে বিজ্ঞানীরা নিয়মিত বড় বড় গ্রহাণুর গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করছে।

এই মুহূর্তে  অতিকায় গ্রহাণু পৃথিবীর দিকে ধেয়ে আসছে, এই গ্রহাণুটির নাম Asteroid 52768 বা 1998 OR2 গ্রহাণুটির সম্ভাব্য ব্যাস .-. কিলোমিটার, এটি ৩১,৩২০ কিলোমিটার প্রতি ঘন্টা গতিবেগে পৃথিবীর দিকে ধেয়ে আসছে। অর্থাৎ গ্রহাণুটি প্রতি সেকেন্ডে . কিলোমিটার দুরুত্ব অতিক্রম করছে, যা বন্দুকের চেয়েও প্রায় গুন বেশি বেশি দ্রুত। গ্রহাণুটিকে সাম্প্রতিক সময়ে আবিষ্কার হয়নি, ১৯৯৮ সালের ২৪ জুলাই NEAT-এর জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা এই গ্রহাণুটিকে আবিষ্কার করেন। NEAT অর্থ হলো Near-Earth Asteroid Tracking এটি যুক্তরাষ্ট্রের মহাকাশ গবেষণা প্রতিষ্টান NASA- আকাশ জরিপের কাজে নিয়োজিত একটি দল। যুক্তরাষ্ট্রের হাওয়াই অঙ্গরাজ্যের হালেকালা মানমন্দির থেকে সর্বপ্রথম গ্রহাণুটির গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করা হয়। তবে পুরোনো মহাকাশ আর্কাইভে থাকা ছবি পর্যালোচনা করে ১৯৮৭ সাল থেকে এই গ্রহাণুটির গতিপথ বের করা গেছে। দীর্ঘ ৩২ বছর গ্রহাণুটির চলার গতিপথ পর্যবেক্ষণ করে জানা যায়, এই গ্রহাণুটির পৃথিবীকে আঘাত করার সম্ভাবনা খুবই কম, তবে এটি পৃথিবীর খুব কাছ দিয়ে অতিক্রম করবে। NASA- পর্যবেক্ষণ অনুযায়ী, আগামী ২৯ এপ্রিল আমেরিকান সময় ভোর :৫৬ মিনিট এবং বাংলাদেশ সময় দুপুর :৫৬ মিনিটে অতিকায় এই গ্রহাণুটি পৃথিবীকে অতিক্রম করবে। গ্রহাণুটি অতিক্রম করে যাওয়ার সময় পৃথিবী থেকে এর দুরুত্ব হবে প্রায় ৬২ লক্ষ কিলোমিটার, এটি পৃথিবী থেকে চাঁদের দুরুত্বের প্রায় ১৬ গুন। অর্থাৎ পৃথিবী থেকে চাঁদ যত দূরে এই গ্রহাণুটি তার থেকেও ১৬ গুন দূর দিয়ে যাবে। এই দুরুত্বের  হিসাব শুনতে অনেক বেশি মনে হলেও মহাকাশের গতিশীল বস্তুর ক্ষেত্রে ৬২ লক্ষ কিলোমিটার খুব বেশি দুরুত্ব নয়।


1998 OR2 গ্রহাণুটি পৃথিবীর দিকে ধেয়ে আসা সবচেয়ে বড় গ্রহাণু নয়। অতীতেও বড় বড় গ্রহাণু পৃথিবীকে অতিক্রম করে গেছে এবং বেশ কয়েকটি পৃথিবীর সাথে সংঘর্ষও বাঁধিয়েছে। প্রায় ৫০ হাজার বছর আগে এত বড় কোনো গ্রহাণু পৃথিবীতে আঘাত হেনেছিল। যুক্তরাষ্ট্রের এরিজোনায় সেই গ্রহাণুর আছড়ে পড়ার ফলে যে বিশাল গর্তের সৃষ্টি হয়েছিল তা থেকেই এর ধ্বংসযজ্ঞের আলামত পাওয়া যায়। তারও বহু আগে প্রায় সাড়ে কোটি বছর আগে একটি গ্রহাণু পৃথিবীতে আছড়ে পড়ার পর আবহাওয়াই বদলে যায়, সেই গ্রহাণুর আঘাতেই পৃথিবী থেকে ডাইনোসরসহ তৎকালীন পৃথিবীর প্রায় ৭০ শতাংশ প্রাণী বিলুপ্ত হয়ে যায়। এরপরও ছোটোখাটো বহু গ্রহাণু পৃথিবীতে আঘাত হেনেছে এবং পৃথিবীর খুব কাছ দিয়ে অতিক্রম করেছে। ২০১৭ সালের সেপ্টেম্বর প্রায় কিলোমিটার ব্যসের একটি গ্রহাণু পৃথিবীর খুব কাছ দিয়ে অতিবাহিত হয়, 1981 ET3 নামের সেই গ্রহাণুটি ২০৫৭ সালের সেপ্টেম্বর আবারো পৃথিবীর খুব কাছ দিয়ে অতিক্রম করবে। এরকম প্রচুর মহাকর্ষীয় বস্তু পৃথিবীর চারপাশে প্রতিনিয়ত ঘুরছে। যাদের আকৃতি, ভর, গতিবেগ এবং সম্ভাব্য গতিপথ পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে নজরদারি করা হয়। বর্তমানে নাসা পৃথিবীর নিকটবর্তী প্রায় ২০ হাজার বস্তুর সার্বক্ষণিক পর্যবেক্ষণ করছে। পর্যবেক্ষণ থেকে প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে জানা যায় আগামী ১০০ বছরে এমন বড় কোনো গ্রহাণু সরাসরি পৃথিবীতে আঘাত হানার সম্ভাবনা নেই  বললেই চলে।

যদিও গ্রহাণু 1998 OR2 পৃথিবীতে আঘাত হানবে না, তারপরও এর বিশাল আকৃতি, অতি উচ্চ গতিবেগ সম্ভাব্য তেজস্ক্রিয় পদার্থের উপস্থিতির কারণে কিছুটা শঙ্কা থেকেই যায়। কোনো কোনো বিজ্ঞানী মনে করছেন পৃথিবীর কাছ দিয়ে অতিবাহিত হওয়ার ফলে পৃথিবীর চুম্বকক্ষেত্রের সামান্য পরিবর্তন আসতে পারে। গ্রহাণুটির অতিক্রমের ফলে অতি সামান্য সময়ের জন্য পৃথীবীর কিছু অঞ্চলে সূর্যের আলো বাধা প্রাপ্ত হতে পারে। এছাড়া এর প্রভাবে কোনো কোনো এলাকায় এসিড বৃষ্টির সম্ভাবনাও রয়েছে। যদিও সম্ভাবনা অতি সামান্য তবুও সম্ভাবনাগুলোকে একেবারে উড়িয়েও দেয়া যায় না। তবে সবচেয়ে আশংকার ব্যাপার হলো গ্রহাণুটির চলার পথে মহাকাশে থাকা অন্য কোনো বস্তুর মধ্যাকর্ষণ শক্তির ফলে এর গতিপথ পরিবর্তন হয়ে যেতে পারে। অত্যন্ত দ্রুত গতিতে চলা এসব গ্রহাণু সামান্য মধ্যাকর্ষণ বলের প্রভাবেও গতিপথ পরিবর্তন করতে পারে। এছাড়া গ্রহাণু এবং উল্কাপিণ্ডের গতিপথ পরিবর্তনের আরেকটি তত্ত্ব হলো, ইয়ারকোভস্কি ইফেক্ট। এই তত্ত্ব অনুযায়ী অভ্যন্তরীণ বা বাহ্যিক কোনো তেজস্ক্রিয় পদার্থের প্রভাবে একটি গ্রহাণুর তাপমাত্রার পরিবর্তন ঘটে, এর ফলে গ্রহাণুটি যেকোনো দিকে ঘুরে যেতে পারে। এমনকি তাদের কক্ষপথেরও পরিবর্তন ঘটতে পারে। মেক্সিকোর ইউকাটান অঞ্চলে ডাইনোসর কিলার এস্টেরিওড পৃথিবীর যত ক্ষতি করেছিলো , আসন্ন এই গ্রহাণু পৃথিবীতে আছড়ে পড়লে ততটা ক্ষতি না হলেও যা হবে তা ধ্বংসেরই নামান্তর। আশার কথা হচ্ছে আগামী ২৯ এপ্রিল এই গ্রহাণুটি পৃথিবীতে আঘাত হানছে না, তবে নাসা 1998 OR2 গ্রহাণুটিকে সম্ভাব্য বিপদজনক আখ্যা দিয়ে বলেছে, দূর ভবিষ্যতে এই গ্রহাণুটি তার কক্ষপথে ঘুরতে ঘুরতে আবারো পৃথিবীর খুবই কাছে চলে আসতে পারে। এমনকি ভবিষ্যতে পৃথিবীর সাথে এর সংঘর্ষও ঘটতে পারে। শুধু গ্রহাণুই নয় পৃথিবীর চারপাশ ঘিরে থাকা বিপুল পরিমান মহাকাশ বর্জ্য আমাদের মহাকাশকে বিপদজনক করে তুলছে। মহাকাশে থাকা পুরোনো রকেটের বিভিন্ন অংশ কৃত্রিম উপগ্রহের ভগ্নাংশ প্রবল বেগে অনিয়ন্ত্রিতভাবে পৃথিবীর চারদিকে ঘুরছে। এত বিপুল পরিমান বর্জ্য এক সময় পৃথিবীতে বসবাসের জন্য মারাত্মক হুমকি সৃষ্টি করবে।



No comments:

Post a Comment