শত শত বছর ধরে রাশিয়াকে যারা শাসন করতো তাদের উপাধি ছিল জার। সোভিয়েত ইউনিয়নের ইতিহাসের শুরু হয়েছিল জারদের শাসনের অবসানের মাধ্যমে। ২০ শতকের শুরু দিকে রাশিয়া বেশ কিছু যুদ্ধে পরাজয় বরণ করে। রুশ-জাপানিজ যুদ্ধ এবং প্রথম বিশ্ব যুদ্ধ এর মধ্যে অন্যতম। যুদ্ধে পরাজয় এবং জার নিকোলাসের অত্যাচারী শাসনে রুশ বিপ্লবী দলগুলোর মধ্যে বিদ্রোহ দানা বাঁধতে শুরু করে। বিপ্লবী দলগুলো সমাজে এলিট শ্রেণীর শাসনের অবসান ঘটিয়ে শ্রমিক শ্রেণীর শাসন প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিলো। এই বিপ্লবী দলগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো বলশেভিক (Bolsevic)। বলশেভিকদের নেতৃত্বে ছিলেন ব্ল্যাদিমির লেনিন (Vladimir Lenin)। ১৯১৭ সালে রাশিয়ায় পর পর দুটি বিপ্লব সংঘটিত হয়, প্রথম বিপ্লবে জারকে ক্ষমতা থেকে অপসারণ করা হয় এবং দ্বিতীয় বিপ্লবে অন্তরবর্তীকালীন সরকার সরিয়ে স্থানীয় শ্রমিক শ্রেণীকে ক্ষমতায় বসানো হয়। ক্ষমতায় আসা এসব শ্রমিককে সোভিয়েত বলা হতো।
১৯১৮-১৯২০ সালে পর্যন্ত সাবেক জারের অনুগত সাদা দল এবং বিপ্লবী লাল দলের মধ্যে গৃহ যুদ্ধ চলে। গৃহ যুদ্ধে লাল দল জয়ী হলে ১৯২২ সালে কমিউনিস্ট আদর্শে একত্রিত হয়ে বিশ্বের প্রথম সমাজতান্ত্রিক দেশ ইউনিয়ন অফ সোভিয়েত সোশ্যালিস্ট রিপাবলিক (Union of Soviet Socialist Republic) গঠিত হয়। ব্ল্যাদিমির লেনিনকে সোভিয়েত ইউনিয়নের রাষ্ট্র প্রধান বানানো হয় এবং বলশেভিক পার্টির নামকরণ করা হয় কমিউনিস্ট পার্টি। লেনিন ক্ষমতায় এসে দেশের শিল্পগুলোকে জাতীয়করণ করে সেই সাথে নাগরিকদের মধ্যে জমি বন্টন করে দেয়া হয়। যারা লেনিনের বিরোধিতা করেছিল তাদেরকে হত্যা করা হয় অথবা কারাগারে প্রেরণ করা হয়। সেসময় বন্দীদেরকে রেড টেরর (Red Terror) নামক এক বন্দিশালায় আটকে রাখা হতো। সোভিয়েত ইউনিয়ন প্রতিষ্টার মাত্র দুই বছরের মধ্যে ব্ল্যাদিমির লেনিন মারা গেলেও সোভিয়েত ইউনিয়ন লেনিনের যুগান্তকারী ব্যাক্তিত্বকে রাজনৈতিক আদর্শ হিসেবে ব্যবহার করতে শুরু করে। এই রাজনৈতিক আদর্শ মার্ক্সীয় লেনিনবাদ নামে পরিচিত হয়। যা মূলত কমিউনিজমেরই একটি ধারা।
লেনিনের মৃত্যুর পর আরেকজন বলশেভিক বিপ্লবী জোসেফ স্ট্যালিন সোভিয়েত ইউনিয়নের ক্ষমতায় আসে। লেনিনের সাথে স্ট্যালিনের কিছু গুরুতর বিষয়ে মতবিরোধ ছিল, লেনিনের সাথে এসব মতপার্থক্য গোপন করে স্ট্যালিন একজন স্বৈরশাসক হিসেবে রাষ্ট্র পরিচালনা করে। দেশকে অর্থনৈতিক পরাশক্তি বানাতে স্ট্যালিন দ্রুত শিল্পায়নে মনোযোগ দেয়। রাষ্ট্র পরিচালনায় স্ট্যালিনের পঞ্চ বার্ষিকী পরিকল্পনাগুলো সফল হলেও এ সাফল্য এসেছিলো চরম মূল্যের বিনিময়ে। সেসময় লক্ষ লক্ষ মানুষকে অন্যায়ভাবে গুলাগ নামক লেবার ক্যাম্পে আটকে রাখা হয়েছিল। মানবসৃষ্ট দুর্বিক্ষের কারণে সেসময় ১০ লাখের বেশি মানুষ মারা গিয়েছিলো। সমাজতন্ত্রে উৎপাদিত ফসল রাষ্ট্রের সম্পত্তি, আর সে কারণে নিজেদের উৎপাদিত ফসল থাকার পরেও কৃষি শ্রমিকরা পর্যাপ্ত খাবার পেতো না। ১৯৩০ সালে স্ট্যালিন "গ্রেট পাৰ্জ" নামের অভিযান পরিচালনা করে। এই অভিযানে সমাজতন্ত্রের শত্রূ হিসেবে চিহ্নিত করে অনেক বুদ্ধিজীবী ও রাজনৈতিক নেতাকে হত্যা করা হয় অথবা নির্বাসনে পাঠানো হয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালে স্ট্যালিন নাৎসির জার্মানির সাথে শান্তি চুক্তি করে। ১৯৪১ সালে জার্মানি শান্তি চুক্তি ভঙ্গ করে রাশিয়া আক্রমণ করে। সে সময় স্ট্যালিন লাখ লাখ সৈন্যকে মৃত্যু মুখে পাঠিয়ে হলেও নাৎসি আক্রমণ প্রতিহত করতে সক্ষম হয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে স্ট্যালিন সরকার বিশ্বের অন্যান্য দেশে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবে অর্থায়ন করতে শুরু করে। এর ফলে পুঁজিবাদী যুক্তরাষ্ট্রের সাথে স্নায়ু যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে সোভিয়েত ইউনিয়ন। ১৯৫৩ সালে স্ট্যালিনের মৃত্যুর পর স্ট্যালিনকে জাতীয় বীর হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া হয়। যে বীর সোভিয়েত ইউনিয়নকে নাৎসি আগ্রাসন থেকে রক্ষা করে শিল্পায়নের যুগে নিয়ে এসেছিলো। অনেকের মতে স্ট্যালিনের এই সময়েই সোভিয়েত ইউনিয়ন উন্নতির চরম শিখরে আরোহন করেছিল।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে এর একমাত্র প্রতিদ্বন্দ্বী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র হলেও দেশটির পতন হয়েছিল এর অভ্যন্তরীণ সংকটের কারণে। সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন শুরু হয়েছিল এর সর্বশেষ প্রেসিডেন্ট মিখাইল গর্ভাচেভের হাত ধরে। গর্ভাচেভ ক্ষমতায় ছিল ১৯৮৫ সাল থেকে ১৯৯১ সাল পর্যন্ত। দেশজুড়ে ক্রমবর্ধমান জন অসন্তোষ মোকাবেলা করতে গর্ভাচেভ অনেকগুলো সংস্কার বাস্তবায়ন করেছিল। ১৯৬৫ সাল থেকে ১৯৮৫ সাল পর্যন্ত সোভিয়েত ইউনিয়নের স্থবিরতার যুগের শেষে মিখাইল গর্ভাচেভ ক্ষমতায় এসেছিলো। এই স্থবিরতার অনেকগুলো কারণ ছিলো ,এর মধ্যে সব চেয়ে উল্লেখযোগ্য হলো লিওনেড ব্রেজনিয়ার্ডের শাসনামলে বাস্তবায়িত কিছু অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সামরিক সিদ্ধান্ত। সামরিক শক্তি ও মহাকাশ অভিযানে যুক্তরাষ্ট্রকে পিছনে ফেলতে বেপরোয়া হয়ে উঠেছিল সোভিয়েত ইউনিয়ন। এসব কারণে অত্যধিক খরচের বোঝা বহন করতে গিয়ে সোভিয়েত অর্থনীতি ধাবিত হচ্ছিলো উৎপাদন ঘাটতি ও স্থবিরতার দিকে। এছাড়াও বহু দশক ধরে অত্যাচারী কমিউনিস্ট শাসনের জের ধরে সরকার জনগণের আস্থা হারাচ্ছিল সেই সাথে বৃদ্ধি পাচ্ছিলো জন অসন্তোষ ও আন্দোলন। গর্ভাচেভ নতুন নেতা হিসেবে ক্ষমতায় এসে স্থবিরতা দূর করতে দুটি সংস্কার নীতি গ্রহণ করেছিল। প্রথমটির নাম ছিল, গ্লাসনস্ট (Glasnost) যার অর্থ স্বচ্ছতা। কমিউনিস্ট পার্টি গোপন পুলিশ বাহিনীর মাধ্যমে অনেকদিন ধরে বিরোধী রাজনৈতিক মত দমন করছিলো। গ্লাসনস্ট নীতি এধরণের কার্যক্রম বন্ধ করে এবং পরোক্ষ ভাবে স্বাধীনতার প্রেরণা যোগায়। এই স্বচ্ছতা নীতি সোভিয়েত সরকারের উপর কমিউনিস্ট প্রভাব কমাতে চেষ্টা করে, যা পরবর্তীতে প্রতিদ্বন্দ্বিতা মূলক বহুদলীয় নির্বাচনের পথকে সুগম করে। দ্বিতীয় নীতিটির নাম ছিল, প্রেস্ট্রিকা (Prestroika ) বা পুনর্গঠন। এটা ছিল সরকার নিয়ন্ত্রিত অর্থনৈতিক কাঠামো থেকে বেরিয়ে আসার প্রচেষ্টা, যার লক্ষ্য ছিল সম্পত্তিতে ব্যক্তি মালিকানা প্রতিষ্টা করা। এই গ্লাসনস্ট ও প্রেস্ট্রিকা নীতি সোভিয়েত অর্থনীতি ও রাজনীতির ধারাকে সম্পূর্ণভাবে বদলে দিয়েছিলো। দূর্ভাগ্যবসত এই ব্যাপক পরিবর্তন এত বছরের রাষ্ট্র শাসনকে বদলে দিতে ব্যর্থ হয়। গর্ভাচেভের ভাষায় "নতুন ব্যবস্থা চালু হওয়ার পূর্বেই, পুরোনো ব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে এবং সামাজিক সংকট আরো তীব্র হয়েছে "।
এই অন্তর্বর্তীকালীন সময়ে সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং তার দূরবর্তী রাজ্যসমূহের অর্থনীতি ও জীবনযাত্রার মানের ব্যাপক অবনতি হয়েছিল। ধীরে ধীরে গ্লাসনস্ট বা স্বচ্ছতা নীতির ফলস্বরূপ পূর্ব ইউরোপীয় রাজ্যসমূহ উন্মুক্ত নির্বাচন আয়োজন করতে শুরু করে। পোল্যান্ডের নির্বাচনে একটি নন-কমিউনিস্ট পার্টি বিজয়ী হয় এবং পোল্যান্ড স্বাধীনতা ঘোষণা করে। পোল্যান্ডই সর্বপ্রথম স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে বেরিয়ে আসে। এর পরেই অন্যান্য নির্ভরশীল রাজ্যগুলো শান্তিপূর্ণ ক্ষমতা পরিবর্তনের চেষ্টা শুরু করে। এই প্রচেষ্টা সমগ্র সোভিয়েত ইউনিয়ন জুড়ে এক ধরণের অস্থিরতা তৈরী করে। ১৯৯১ সালের আগস্ট মাসে একদল চরমপন্থী কমিউনিস্ট পার্টি সদস্য গর্ভাচেভের বিরুদ্ধে অভ্যুথানের চেষ্টা করে। এই অভ্যুথান সফল না হলেও গর্ভাচেভ কমিউনিস্ট পার্টি থেকে পদত্যাগ করে। এই অভ্যুথান চলাকালেই একাধিক বাল্টিক রাজ্য স্বাধীনতা ঘোষণা করে। ১৯৯১ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে ইউক্রেন, রাশিয়া, বেলারুশ, আর্মেনিয়া, আজারবাইজান, কাজাখিস্তান, কিরগিজিস্তান, মালদোভা, তুর্কমেনিস্তান, তাজিকিস্তান এবং উজবেকিস্তান সোভিয়েত ইউনিয়ন ত্যাগ করে। এর অল্প কিছু দিনের মধ্যে শুধু কাগজে কলমে জর্জিয়ায় ক্ষমতায় থাকা সোভিয়েত ইউনিয়ন বিলুপ্ত হয়। এভাবেই ৬৯ বছরে গড়ে উঠা বিশ্ব শক্তি সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন হয়।
No comments:
Post a Comment