অপার সম্ভাবনার এক দেশ বাংলাদেশ। বিগত কয়েক বছরে বাংলাদেশ সামরিক, রাজনৈতিক, শিক্ষাসহ সকল খাতে অসংখ্য উন্নয়ন সাধন করেছে। আর এই সম্ভাবনাময় দেশের হাতিয়ার হিসেবে হরণী ও চানন্দী ইউনিয়নের সীমানা পেরিয়ে পূর্ব-দক্ষিণে বিশাল এক ভূমির দেখা মিলেছে যা বর্তমানে স্বর্ণ দ্বীপ হিসেবে পরিচিত।
স্বর্ণ দ্বীপের আয়তনের কথা বলতে গেলে তা প্রায় একটি উপজেলার আয়তনের সমান।১৯৭৮ সালে জাহাইজ্জ্যার চর নামে পরিচিত স্বর্ণদ্বীপ বঙ্গোপসাগর ও মেঘনা নদীর মোহনায় জেগে উঠা একটি চর। যা নোয়াখালী জেলা তথা চট্টগ্রাম বিভাগের অন্তর্গত।চরটি জেগে উঠার পর প্রথমে একে চর রুহুল আমিন নামে নামকরণ করা হয়।পরবর্তীতে এর নাম পরিবর্তন করে নতুন নাম রাখা হয় "স্বর্ণদ্বীপ"।
আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর পদচারণাকম থাকায় চরের পার্শ্ববর্তী এলাকার অপরাধ সংঘটনের জন্য প্রথম থেকেই চরটি মূলত জলদস্যূদেরজন্য অভয়ারণ্য হয়ে উঠে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সময়োপযোগী ও যুগান্তকারী সিদ্ধান্তের প্রেক্ষিতে আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নয়ন, সেনাবাহিনীর প্রশিক্ষণ কার্যক্রম পরিচালনা সর্বোপরি পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষার্থে পরিকল্পিত বনায়ন প্রকল্প বাস্তবায়নের লক্ষ্যে চরটি বাংলাদেশ সেনাবাহিনীকে হস্তান্তর করা হয়। এর প্রেক্ষিতে সেনাবাহিনীর ৩৩ পদাতিক ডিভিশনের অধীনে ১০১ পদাতিক ব্রিগেড হতে ষষ্ঠ বাংলাদেশ ইনফ্রেনটি রেজিমেন্ট ২০১০ সালের ১০ই এপ্রিল সর্বপ্রথম স্বর্ণদ্বীপে কার্যক্রম শুরু করে। জলদস্যু ও তাদের আস্তানা নিধনে সাঁড়াশি অভিযান পরিচালনার মাধ্যমে চরের বিভিন্ন স্থান হতে প্রচুর পরিমানে গোলাবারুদ এবং স্বয়ংক্রিয় ও দেশীয় ধারালো অস্র উদ্ধার করা হয়। ২৪শে জুলাই ২০১৪ সালে ভূমি মন্ত্রণালয় হতে প্রকাশিত সরকারি বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে বর্তমান সরকার স্বর্ণদ্বীপের সমুদয়
খাস জমি সেনাবাহিনীর কাছে স্থায়ীভাবে দীর্ঘমেয়াদি বন্দোবস্ত দেয়। স্বর্ণদ্বীপে একইসাথে বনায়ন, পশুপালন ও প্রশিক্ষণ কর্মকান্ড পরিচালনা করার জন্য ৩৩ পদাতিক ডিভিশনের অধীনস্ত ৩৩ আর্টিলারি ব্রিগেডের তত্ত্বাবধানে এই টাস্কফোর্স ডিভিশনের বিভিন্ন ছোট বড়ো
উপদল এবং ডিভিশন ইঞ্জিনীরিং ব্যাটালিয়নের সহায়তায় স্বর্ণদ্বীপের সকল কার্যক্রমের সমন্বয় ও উন্নয়ন কর্মকান্ড পরিচালনা করছে।
এই চরের দেখা পাওয়া যায় নোয়াখালী জেলা থেকে প্রায় ১০ কিলোমিটার দক্ষিণ দিকে , হাতিয়া হতে প্রায় ১৩.৫ কিলোমিটার উত্তর দিকে , সন্দীপ হতে প্রায় ৪.৫ কিলোমিটার পশ্চিমে। বর্তমানে এর আয়তন প্রায় ২৮ কিলোমিটার দৈর্ঘ্য এবং প্রায় ১৪ কিলোমিটার প্রস্থ। এই চর মূলত একটি সমতলভূমি, এখানকার মাটি পলি, দোআঁশ হলেও লবনাক্ত হওয়ার ফলে খুব বেশি উর্বর নয়। পুরো চর জুড়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে অসংখ্য খাল। বর্ষা মৌসুমসহ বছরের অধিকাংশ সময় জুড়ে এই চরের প্রায় পুরো জায়গাই থাকে জলাবদ্ধ অবস্থায়। তবে শুস্ক মৌসুমে চরের মূলভূখণ্ড শুকনো ও চলাচলযোগ্য হয়ে উঠে।
বছরের
এপ্রিল থেকে নভেম্বর পর্যন্ত
এই ৮ মাস স্বর্ণদ্বীপে
বর্ষা মৌসুম দেখা যায়। এ
সময় চরের অধিকাংশ এলাকায়ই
জলাবদ্ধ থাকে। সাধারণত এপ্রিল ও মে মাসে
স্বর্ণদ্বীপে কালবৈশাখী ও ঘূর্ণিঝড়ের প্রাদুর্ভাব
অনেক বেশি থাকে। ঝড়ের প্রভাবে প্রতি
বছরই চরের নানাবিধ ক্ষয়ক্ষতি
হয়ে থাকে। ডিসেম্বর থেকে মার্চ পর্যন্ত
৪ এই মাস স্বর্ণদ্বীপে
শুষ্ক মৌসুম বিরাজ করে।
এই
চরের অন্যতম প্রধান সমস্যা হলো এর অভ্যন্তরীণ
যোগাযোগ ব্যবস্থা। বর্ষা মৌসুমে বেশিরভাগ এলাকা জলাবদ্ধ থাকায় যে কোনো প্রকার
যান চলাচল সম্পূর্ণ স্থবির হয়ে যায়। এ
সময় নির্ভরযোগ্য বাহন হিসেবে কেবল
মাত্র ট্র্যাক্টর ও ড্র্যাম্পার্ড ট্রাক
ব্যবহার করা হয়। ভরাবর্ষার
মাটি এতটাই নরম থাকে যে
ড্র্যাম্পার্ড ট্রাককে ট্রাক্টরের সাহায্যে টেনে নিতে হয়।
বর্তমানে সেনাবাহিনী কর্তৃক গানার্স ঘাট হতে সেপার্স
ক্যাম্প হয়ে ময়নামতি ক্যাম্প
পর্যন্ত প্রায় ১০ কিলোমিটার দীর্ঘ
একটি অস্থায়ী রাস্তার মাটি ভরাটের কাজ
প্রায় শেষের পথে। এই রাস্তা নির্মাণ
সম্পূর্ণ হলে সকল মৌসুমে
চরের অভ্যন্তরীণ যোগাযোগ ব্যবস্থা অনেক সহজ ও
কার্যকরী হয়ে উঠবে বলে
ধারণা করা যায়। প্রায়
বৃক্ষশুন্য এই চরে সেনাবাহিনী
কর্তৃক পরিচালিত বৃক্ষ রোপন অভিযানের আওতায়
ইতোমধ্যে ম্যানগ্রোভসহ বিভিন্ন রকমের বনাজী ও ফলজ চারা
রোপন করা হয়েছে। এছাড়াও
বৃক্ষ রোপন অভিযানের অংশ
হিসেবে চরের দুর্গম এলাকায়
প্রায় ২০০০ কেজি কেওড়া
বীজ হেলিকপ্টার থেকে ছড়ানো হয়েছে।
এছাড়াও ভিয়েতনাম থেকে আনা প্রায়
১৫০০ প্রজাতির নারিকেল চারা নিবিড় পরিচর্যার
আওতায় আছে। এই নারিকেল
বাগানে একইসাথে সবজি ও শিং,
মাগুর সহ অন্যান্য মাছের
চাষ করা হবে যা
খুবই ফলপ্রসূ। সম্প্রীতি সেনাবাহিনী ১০ একর জমিতে
পরীক্ষামূলক ধান চাষ শুরু
করেছে একই সাথে স্থানীয়
বর্গাচাষীদের দ্বারা আরো প্রায় ৬০
একর জমিতে ধান চাষ করা
হচ্ছে। ভবিষ্যতে অন্যান্য শস্য আবাদের পরিকল্পনাও
সেনাবাহিনীর রয়েছে।
স্বর্ণদ্বীপে
স্থানীয় ২০৯ জন মালিকের
তত্ত্বাবধানে বর্তমানে ২০টি খামার পরিচালিত
হয়। এই খামার গুলোতে
১৩১৩২টি মহিষ , ৮২১১ টি গরু
এবং ১৬২৬৫টি ভেড়া আছে। খামারগুলো
মূলত দুগ্ধ আহরণের জন্য পরিচালিত হয়।
বেসামরিক খামার গুলো ছাড়াও সেনাবাহিনীর
মিলিটারি ফার্মের একটি শাখা স্থাপন
করা হয়েছে। বর্তমানে এই মিলিটারি ফার্মে
১৫০টি মহিষ, ২০০টি ভেড়া এবং ১৫০০টি
হাঁস আছে।এছাড়া এখানে পনির তৈরির জন্যও
একটি ছোট কারখানা স্থাপন
করা হয়েছে। ভবিষ্যতে এই চরে পশু
প্রজনন, দুগ্ধ সংগ্রহ ও সংরক্ষণের পরিকল্পনা
রয়েছে। সেনাবাহিনীর তত্ত্বাবধানে কৃত্রিম জলাশয় ও পুকুর খনন
করে বিগত প্রায় ২
বছর ধরে মাছ চাষ
করা হচ্ছে। ভবিষ্যতে আরো পুকুর এবং
জলাশয় খনন করে মাছের প্রজাতি
বৃদ্ধির মাধ্যমে বৃহৎ আকারে মাছের
চাষের পরিকল্পনা রয়েছে।
দেশের
মূলভূখণ্ড থেকে চরে পৌঁছানোর
জন্য প্ৰধারণত ট্রলার ব্যবহার করা হয়। সেনাবাহিনীর
নিজস্ব অর্থায়নে ইতোমধ্যে ৩টি ট্রলার ক্রয়
করা হয়েছে। এছাড়া বিভিন্ন প্রশিক্ষণ ও অনুশীলন চলাকালে
বিভিন্ন সামরিক যানবাহন আর্মড পার্সোনাল ক্যরিয়ার , ট্যাংক ও সেলফ প্রোপেলড
গানসহ অন্যান্য ভারী সরঞ্জামাদি পরিবহনে
সেনাবাহিনীর এলসিভি (LCV) ও এলসিটি (LCT) ব্যবহার
করা হয়। সম্প্রতি বিআইডব্লিউটি (BIWT)-এর সহায়তায় বাংলাদেশ
সেনাবাহিনী নোয়াখালী জেলার জনতার ঘাট এলাকায় একটি
হালকামানের জেট স্থাপন করেছে। এতে করে জনবলসহ
হালকা দ্রব্যাদি নৌযানে উঠানো ও নামানো সহজ
হয়েছে। তবে নদী ভাঙ্গনের
কারণে স্বর্ণদ্বীপে বিকল্প কোনো জেট স্থাপন
সম্ভব হয়নি। বিআইডব্লিউটি (BIWT)-এর সহায়তায় একটি স্থায়ী জেট নির্মাণ করা হলে ট্যাংক,
আর্মড পার্সোনাল ক্যরিয়ার সহ অন্যান্য ভারী
সরঞ্জামাদি পরিবহন আরো দ্রুত ও
সহজতর হবে।
প্রাথমিক
পর্যায়ে সেনা সদস্যের আবাসনের
জন্য কন্টেইনার বেসড আবাসনের মাধ্যমে
একটি ক্যাম্প স্থাপন করা হয় যা
বর্তমানে সেপার্স ক্যাম্প নামে পরিচিত। পরবর্তীতে এখানে ২টি সাইক্লোন সেন্টার
নির্মাণ করা হয় যা
ময়নামতি ক্যাম্প ১ ও ২
নামে পরিচিত। এই সাইক্লোন সেন্টার
দুটি দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ায় স্থানীয় নিরাপত্তার জন্য ব্যবহৃত হবে।
এছাড়াও গভীর নলকূপ ও
জলাধার স্থাপন করে বৃষ্টির পানি
সংরক্ষণ করে ওয়াটার হার্ভেস্টিংয়ের
মাধ্যমে দুটি ক্যাম্পেই সুপেয়
পানির স্থায়ী ব্যবস্থা করা হয়েছে। দুটি
ক্যাম্পের পাশেই বৃহৎ আকারের পুকুর
নিত্য ব্যবহার্য পানি চাহিদা পূরণ
করছে। এছাড়া চরে হেলিকপ্টার অবতরণের জন্য রয়েছে বিশেষ সুবিধা, বর্তমানে এই চরে ৪টি
হেলিপ্যাড নির্মাণ করা হয়েছে। চরে মোতায়েনকৃত সেনা সদস্যদের চিকিৎসা
সেবা প্রদানের জন্য শুষ্ক মৌসুমে
একটি মোবাইল হাসপাতাল ও সার্বক্ষণিক এমএই
(MI) রুল সুবিধা স্থাপন করা হয়েছে। এই
হাসপাতাল সমূহ হতে স্থানীয়
জনসাধারণকে জরুরি চিকিৎসা সেবা প্রদান করা
হয়। সেনাবাহিনীর নিজস্ব অর্থায়নে স্বর্ণদ্বীপে রেডিও লিংকের মাধ্যমে কুমিল্লা সেনা নিবাসের টেলিফোন
সংযোগ প্রদান করা হয়েছে, ফলে
চরের ক্যাম্পসমূহের সাথে দেশের যেকোনো
সেনা নিবাসের সরাসরি টেলিফোন যোগাযোগ চালু রয়েছে। এছাড়াও
গ্রামীনফোন একটি মোবাইল টাওয়ার
স্থাপন করায় বর্তমানে স্বর্ণদ্বীপে
পর্যাপ্ত টেলি যোগাযোগের মাধ্যম
বিদ্যমান।
বিগত
২০১৪ সালে ৩৩ পদাতিক
ডিভিশনের ৪৪ পদাতিক ব্রিগেডের
একটি ব্যাটেলিয়ন দল স্বর্ণদ্বীপে প্রথম
বৃহদাকার অনুশীলন পরিচালনা করে। পরবর্তীতে সেনাবাহিনীর
অন্যান্য ডিভিশনসমূহ হতে সর্বমোট ১৫টি
দল সফল অনুশীলন পরিচালনা
করেছে। সেনাসদর, সামরিক প্রশিক্ষণ পরিদপ্তর ও আর্মি ট্রেনিং
এন্ড ডক্টরিং কমান্ড স্বর্ণদ্বীপে বৃহদাকারের একটি স্বয়ংক্রিয় অনুশীলন
এলাকা নির্মাণের জন্য বিস্তারিত পরিকল্পনা
প্রণয়ন করেছে। অনুশীলনের জন্য পরিকল্পিত ১৬৮টি
কৃত্রিম প্রশিক্ষণ গ্রামের মধ্যে ২৫টির নির্মাণ কাজ সম্পূর্ণ হয়েছে।
প্রতিটি কৃত্রিম গ্রামে মহড়ার জন্য রয়েছে বিভিন্ন
প্রতিবন্ধকতা, ট্যাংক ফায়ারিং পজিশন ইত্যাদি। তবে পরিবেশের ভারসাম্য
রক্ষার স্বার্থে সকল অনুশীলনে নূন্যতম
বিস্ফোরক দ্রব্যাদি ব্যবহার হয়। জীববৈচিত্রের অন্যতম
নিদর্শনস্বরূপ এই চরে নিয়মিত
বক, সারস ও মাছরাঙা
সহ বিভিন্ন পাখি চোখে পড়ে।
বিগত কয়েকবছর যাবৎ চরের উত্তর-পশ্চিম অংশে প্রায় ১২-১৪ কিলোমিটার এলাকা
জুড়ে ক্রমবর্ধমান নদী ভাঙ্গন পরিলক্ষিত
হচ্ছে। অতি দ্রুত কার্যকরী
ব্যবস্থা গ্রহণ করা না গেলে
চরের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ
অচিরেই নদী গর্ভে বিলীন
হয়ে যাবে। এই ভাঙ্গন রোধে
পানি উন্নয়ন বোর্ডের সাথে সমন্বক পূর্বক
একটি স্থায়ী ও কার্যকরী ব্যবস্থা
গ্রহণের পরিকল্পনা করা হয়েছে। সে
অনুযায়ী বাস্তবায়নের কাজ শ্রীঘ্রই গ্রহণ
করা হবে বলে আশা
করা যায়। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর
সুদূরপ্রসারী প্রজ্ঞা ও সময়োপযোগী সঠিক
সিদ্ধান্তের সফল বাস্তবায়ন স্বর্ণদ্বীপে
আজ একটি সম্ভাবনাময় নতুন
অধ্যায়ের সূচনা করেছে। স্থায়ী রাস্তা নির্মাণের পাশাপাশি চরে একটি বেসরকারি
হাসপাতাল হলে স্থানীয় জনসাধারণ
আরো বেশি উপকৃত হতো। স্বর্ণদ্বীপে নির্মাণাধীন
অনুশীলন ও প্রশিক্ষণ সুবিধাদি
বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর পেশাদারিত্ব ও কর্মদক্ষতা বৃদ্ধিতে
সহায়ক ভূমিকা রাখবে বলেই আশা রাখি।
No comments:
Post a Comment