বর্তমানে
সারাবিশ্বে ছড়িয়ে পড়েছে Coronavirus disease বা COVID-19 নামের নতুন একধরনের রোগ।
২০১৯ সালের শেষের দিকে আবিষ্কৃত এই
রোগটি, মাত্র ৩ মাসের ব্যবধানে
বিশ্ব জুড়ে মহামারী আকার ধারণ করেছে।
চীনের হুবেই প্রদেশের উহান শহর থেকে
ছড়িয়ে পড়া এই জীবাণু,
চীনের বাইরে সবচেয়ে বেশি সংক্রমিত হয়েছে
ইতালিতে। অত্যন্ত ছোঁয়াচে এই রোগের বিস্তার
ঠেকাতে, সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন সচেতনতা।
১৯৬০-এর দশকে সর্বপ্রথম
করোনা ভাইরাস সনাক্ত করা হয়। কিন্তু
বর্তমানে ছড়িয়ে পড়া করোনা ভাইরাস-এর এই জাতটি
একেবারেই নতুন। ২০১৯ সালের শেষের
দিকে আবিষ্কৃত হওয়ার কারণে এর নাম করা
হয়েছে 2019-nCoV এবং এই রোগকে
বলা হচ্ছে Coronavirus disease বা COVID-19। এই রোগটি
বিস্তারের প্রক্রিয়া চলমান থাকায় COVID-19 নিয়ে এখনো বহু
গবেষণা চলছে। এ বছর ৩০
জানুয়ারী বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা করোনা ভাইরাস মোকাবেলায় বৈশ্বিক স্বাস্থ্যগত জরুরি অবস্থা জারি করে। কিন্তু
তারপরও রোগটি ক্রমাগত ছড়িয়ে পড়তে থাকলে গত
১১ই মার্চ করোনা ভাইরাস সংক্রমণকে বৈশ্বিক মহামারী হিসেবে ঘোষণা করা হয়। করোনা
ভাইরাসবাহিত রোগটি এতটা মারাত্মক নয়
যে, এই রোগে আক্রান্ত
হলেই রোগী মারা যাবে।
বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই রোগীর মৃত্যু ঝুঁকি খুবই কম। এখনো
পর্যন্ত সারা বিশ্বে করোনা
ভাইরাসে আক্রান্ত হয় যতজন মারা
গেছে তাদের অধিকাংশের এর আগে থেকেই
অন্য কোনো শারীরিক সমস্যা
ছিলো। ২০২০ সালের ১৫
এপ্রিল তারিখ পর্যন্ত বিশ্বের ২১০টি দেশে প্রায় ২০
লক্ষ মানুষ COVID-19 এ আক্রান্ত হয়েছে
এবং তাদের মধ্যে ১ লাখের বেশি মানুষ মৃত্যুবরণ
করেছে। তবে আক্রান্তদের অধিকাংশই
কিন্তু সুস্থ হয়ে গেছেন। একবার
করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হলে দ্বিতীয়বার এই
রোগে আক্রান্ত হওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই,
এমনকি আরোগ্য লাভ করা ব্যক্তির
কাছ থেকে এই রোগ
অন্য কারো কাছে ছড়ায়
না। COVID-19 সম্পর্কে এখনো আমাদের জানার
অনেক বাকি আছে। বিশ্ব
স্বাস্থ্য সংস্থা প্রতিনিয়ত নতুন নতুন তথ্য
হালনাগাদ করে করোনা সম্পর্কে
সচেতনতা সৃষ্টি করছে।
নতুন
এই করোনা ভাইরাসের প্রধান সমস্যা হচ্ছে রোগটি অত্যন্ত ছোঁয়াচে। এই রোগ মূলত
মানুষ থেকে মানুষে ছড়ায়।
কোনো আক্রান্ত ব্যক্তি যখন অন্য কারো
সংস্পর্শে আসে তখন হাঁচি-কাশি বা ছিটে
আসা জলকণা থেকে এই ভাইরাসের
জীবাণু ছড়াতে পারে। এসব জলকণা মূলত
মানুষের মুখ থেকে ৩
ফুট দুরুত্বে যেতে পারে, তাই
অধিকাংশ সংক্রমণই ঘটেছে কাছাকাছি থাকা ব্যক্তিদের মধ্যে।
COVID-19-এর জীবাণু অন্য কোনো বস্তুর
উপর কতক্ষন সক্রিয় থাকতে পারে তার সঠিক
তথ্য এখনো জানা যায়নি।
তবে ধারণা করা হয় এই
ভাইরাস বাতাসে ৩ ঘন্টা এবং
প্লাষ্টিক বা স্টিল জাতীয়
বস্তুর উপর ৩ দিন
বেঁচে থাকতে পারে। তাই যেসমস্ত স্থানে
বার বার হাত লাগার
সম্ভাবনা আছে সেসব নিয়মিত
পরিষ্কার করা উচিত, কারণ
হাতের সাথে লেগে থাকা
জীবাণু চোখ, নাক ও
মুখ স্পর্শ করার মাধ্যমে আমাদের
দেহে সংক্রমিত হতে পারে। হাঁচি-কাশির সময় হাতের তালুর
বদলে কনুই দিয়ে মুখ
ঢাকতে হবে অথবা টিস্যু
ব্যবহার করে ব্যবহৃত টিস্যু
ঢাকনাওয়ালা ডাস্টবিনে ফেলতে হবে। এছাড়া ভাইরাসের সংক্রমণ থেকে নিরাপদ থাকতে
কিছুক্ষন পর পর এলকোহলভিত্তিক
হ্যান্ড স্যানিটাইজার বা সাবান দিয়ে
ভালোভাবে হাত ধুতে হবে।
কোনো
ব্যক্তির দেহে নভেল করোনা
ভাইরাস প্রবেশ করলে তার লক্ষণ
প্রকাশ পেতে দুই সপ্তাহ
পর্যন্ত সময় লাগতে পারে।
এ রোগের ক্ষেত্রে ব্যক্তিভেদে সামান্য থেকে অনেক জটিল
লক্ষণ দেখা দিতে পারে।
সাধারণত করোনা ভাইরাসের লক্ষণগুলো হলো, জ্বর, কাশি
এবং শ্বাসকষ্ট। তবে এই জীবাণুর
কারণে নিউমোনিয়া এবং কিডনী নষ্ট
হওয়া থেকে শুরু করে
রোগীর মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে। এখনো
পর্যন্ত করোনা ভাইরাসে মৃত্যুহার সম্পর্কে নিশ্চিত করে কিছুই বলা
যাচ্ছে না। সাধারণত যে
কেউ নভেল করোনা ভাইরাস
দ্বারা আক্রান্ত হলেই গুরুতর অসুস্থ
হয় না। যাদের আগে
থেকে ডায়াবেটিকস, ফুসফুস এবং হৃদযন্ত্রের সমস্যা
আছে তাদের গুরুতর অসুস্থ হওয়ার ঝুঁকি সব চেয়ে বেশি।
কোনো ব্যক্তি COVID-19 এ আক্রান্ত কিনা
তার জন্য যে পরীক্ষা
করা হয় তার নাম
PCR বা Polymerase
Chain Reaction। যেহেতু রোগটি নতুন তাই বিশ্বের
অধিকাংশ দেশেই এর পরীক্ষা ব্যবস্থা
প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল। তবে বাংলাদেশী বিজ্ঞানী
ড. বিজন কুমার শীল
করোনা ভাইরাস সনাক্তকরণের জন্য Rapid Dot Blot নামে নতুন এক
পদ্ধতি আবিষ্কার করেছেন। এই প্রক্রিয়াটি এখনো
যথাযথ কর্তৃপক্ষের অনুমোদনের অপেক্ষায় রয়েছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে করোনা মোকাবেলা
করতে হলে বেশি হতে
বেশি লোকের রোগ পরীক্ষার কোনো
বিকল্প নেই, কারণ পরীক্ষা
করা না গেলে ভাইরাস
আক্রান্ত রোগীর প্রকৃত সংখ্যা জানা যাবে না।
এখনো পর্যন্ত এই রোগের কোনো
বিশেষ ওষুধ নেই। এই
রোগের একমাত্র চিকিৎসা হলো রোগীর সেবা
যত্ন করা। মানবদেহে এই
রোগের সংক্রমণ প্রতিরোধ করতে একাধিক গবেষণা
চলছে। তবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে
ইতিমধ্যেই প্রতিষেধক তৈরী করা হয়েছে।
জেনিফার হেলার নামে ৩৪ বছর
বয়সী এক নারীর শরীরে
এই টিকার পরীক্ষামূলক ডোজ প্রদান করা
হয়েছে। তবে ভ্যাক্সিনটি নিরাপদ
কিনা তা জানতে ও
বিশ্বব্যাপী ব্যবহার উপযোগী করতে আরো বেশকিছু
সময় লাগবে।
বর্তমানে
নভেল করোনা ভাইরাসের বিস্তার রোধে সবচেয়ে জরুরী
ব্যবস্থা হলো কোয়ারেন্টাইন বা
সঙ্গরোধ করা। ভাইরাসে আক্রান্ত
হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে এমন ব্যক্তিদের অবশ্যই
সকলের সংস্পর্শ ত্যাগ করতে হবে। কারো
দেহে ভাইরাস প্রবেশের পর থেকে রোগের
লক্ষণ প্রকাশ পেতে ১৪দিন পর্যন্ত
সময় লাগে, তাই কোয়ারেন্টাইনে থাকা
ব্যক্তিদের অবশ্যই এই নির্দিষ্ট সময়
জনবহুল এলাকা থেকে দূরে থাকতে
হবে। নিজের বাড়িতে কোয়ারেন্টাইন তাদের জন্যই যারা এখনো COVID-19 পজিটিভ
হন নি। এই রোগে
কেউ পজিটিভ হয়ে থাকলে হাসপাতালে
তাদের আলাদা করে রাখাকে বলা
হয় আইসোলেশন। করোনা ভাইরাসে আক্রান্তদের আইসোলেশনে রেখে চীন, দক্ষিণ
কোরিয়া ও সিঙ্গাপুরে রোগটি
অনেকটাই নিয়ন্ত্রণে আনা গেছে। রোগীদেরকে
আইসোলেশনে রাখতে চীন মাত্র ১০দিনে
সম্পূর্ণ নতুন দুইটি হাসপাতাল
তৈরী করেছে। লাইসেনশান এবং হুওসেনশান নামের
এই হাসপাতাল দুটিতে ২ হাজার ৬০০
জন রোগীকে আইসোলেশনে রাখার ব্যবস্থা আছে। সারা বিশ্বের
মতোই দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে করোনা ভাইরাস অত্যন্ত দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে। ইতোমধ্যে বাংলাদেশেও COVID-19 আক্রান্ত রোগী সনাক্ত করা
হয়েছে। এই ব্লগটি লিখার
আগে পর্যন্ত বাংলাদেশে করোনা আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা ১২৩১ জন এবং
তাদের মধ্যে ৫০জন রোগী মৃত্যুবরণ
করেছে এবং ৪৯ জন সুস্থ
হয়ে বাড়ি ফিরেছেন। বর্তমানে
করোনা ভাইরাস মোকাবেলার সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো
পরীক্ষা উপকরণের ঘাটতি। যেসমস্ত দেশে উন্নত চিকিৎসা
ব্যবস্থা রয়েছে তারাও করোনা মোকাবেলায় হিমশিম খাচ্ছে। তাই অপেক্ষাকৃত দুর্বল
চিকিৎসা ব্যবস্থার দেশ এবং নিম্ন
আয়ের দেশগুলোতে করোনার মহামারী আরো ভয়াবহ প্রভাব
ফেলতে পারে। তবে এই মুহূর্তে
চিকিৎসা ব্যবস্থার চেয়েও অধিক প্রয়োজন সঠিক
জনসচেতনতা তৈরী করা। অযথা
আতঙ্কিত না হয়ে সঠিক
তথ্য জেনে সচেতন থাকার
মাধ্যমে আমরা এই রোগকে
নিয়ন্ত্রন করতে পারি।
No comments:
Post a Comment