বর্তমান নাগরিক জীবনে এক আতঙ্কের নাম ডেঙ্গু। রাজধানীসহ সারাদেশে ছড়িয়ে পড়ছে এই রোগ। চলতি বছরে বাংলাদেশে ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা অতীতের সকল রেকর্ড ছাড়িয়েছে। শুধু বাংলাদেশ নয়, দক্ষিণ-এশিয়া ও দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার বহু দেশে ডেঙ্গু জ্বরের প্রকোপ প্রায় মহামারী পর্যায়। মারাত্মক জীবাণুবাহী এডিস মশার কামড়ে মানবদেহে ডেঙ্গু বিরুপ আকারে ছড়িয়ে পড়ে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য অনুযায়ী বিশ্বের ১০০টি দেশের প্রায় ২৫০ কোটি মানুষ ডেঙ্গুর ঝুঁকির মুখে।
ধারণা করা হয় , ডেঙ্গু নামটি এসেছে সোয়াহিলি ভাষার "কা-ডিঙা পেপো " থেকে যার অর্থ খারাপ আত্মা বাহিত রোগ। ১৮শতকের শেষের দিকে এই রোগের আরেকটি নামকরণ করা হয় " ব্র্যাক বোন ফিভার " যার অর্থ হাড়ভাঙ্গা জ্বর। ডেঙ্গু রোগে আক্রান্ত রোগীদের কষ্টের তীব্রতা থেকেই এই রোগের নামকরণ করা হয়েছে। ১৭৭৯ ও ৮০ সালে এশিয়া , আফ্রিকা ও উত্তর আমেরিকায় সর্ব প্রথম ডেঙ্গু মহামারী দেখা যায়। পরবর্তীতে ১৯০৬ সালে প্রথম আবিষ্কার করা হয় "এডিস ইজিপ্টি " নামের এক ধরণের মশা, যা ডেঙ্গু রোগের জীবাণু বহন করে। এই এডিস মশা "ইউরো ফিভার", "জিকা ভাইরাস" ও "চিকুনগুনিয়া" ভাইরাস-এর ও বাহক। পৃথিবীর প্রায় সাড়ে ৩ হাজার প্রজাতির মধ্যে এডিস ইজিপ্টি অন্যতম ভয়ঙ্কর মশা। এ জাতের স্ত্রী মশা ডেঙ্গু নামের এক ধরণের ভাইরাস বহন করে মানব শরীরে ডেঙ্গু রোগ ছড়ায়। ডেঙ্গু ভাইরাস এর ৫টি ধরণ রয়েছে এবং প্রত্যেকটি ধরণের ডেঙ্গু রোগ সৃস্টি করতে পারে। প্রায় ৪০০ বছর আগে আফ্রিকায় এডিস্ মশার জন্ম, পরবর্তীতে ধীরে ধীরে এই মশা পৃথিবীর প্রায় সমগ্র বিষুবীয় অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ে। অনেক গবেষকদের ধারণা, ইউরোপ উপনিবেশ স্থাপনকারীরা আফ্রিকা থেকে মশার এই জাতটি জাহাজে করে এশিয়া ও আমেরিকায় নিয়ে আসে। পরবর্তীতে ১৯৬২ সালে আমেরিকা মহাদেশের ১৮টি দেশ থেকে এডিস এজিপ্টিকে নির্মূল করা হয়। বর্তমানে এই মশা এশিয়া অঞ্চলেই সবচেয়ে বেশি ক্ষতি করছে। তাই এই মশা এশিয়ান টাইগার mosquito নামেও পরিচিত। বাংলাদেশে ২০০০ সালে প্রথম এডিস বাহিত ডেঙ্গু রোগীর সন্ধান পাওয়া যায়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে এশিয়া , আফ্রিকা, অস্ট্রেলিয়া ও উত্তর আমেরিকার ১০০টি দেশের প্রায় ২৫০ কোটি মানুষ ডেঙ্গু ঝুঁকির মুখে। সংস্থাটির মতে, বছরে ৫০ লাখ থেকে ১ কোটি মানুষ ডেঙ্গু ভাইরাস -এ আক্রান্ত হচ্ছে। এর মধ্যে আনুমানিক সাড়ে ১২হাজার মানুষ প্রতি বছর মৃত্যুবরণ করছে। ভাইরাস-এর বিবর্তন, জলবায়ু পরিবর্তন, অপরিকল্পিত ও অত্যধিক জনসংখ্যার নগরায়ন, অপর্যাপ্ত ও অস্বাস্থ্যকর বর্জ্য ও পানি ব্যবস্থাপনার কারণে ডেঙ্গুর বিস্তার সহজে কমানো যাচ্ছে না।
আমাদের শরীর যখন কোনো ভাইরাস দ্বারা আক্রান্ত হয় তখন আমাদের শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা নিজে নিজেই সেই ভাইরাস -এর বিরুদ্ধে কাজ করার শক্তি অর্জন করে। পরিচিত ভাইরাস-এর বিরুদ্ধে কাজ করার এই শক্তিকে বলে এন্টিবডি। কিন্তু বর্তমানে ডেঙ্গু জীবাণুর ক্রস রিঅ্যাকশন এর কারণে ডেঙ্গুর বিরুদ্ধে আমাদের এন্টিবডি ঠিকভাবে কাজ করছে না।
২০০৯ সালে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ডেঙ্গু রোগের কিছু লক্ষণ প্রকাশ করেছিল, সেগুলো হলো -
* তীব্র পেট ব্যথা
* মাত্রাতিরিক্ত বমি হওয়া ( ২৪ ঘন্টায় তিনবারের বেশি)
* শরীরে পানি জমে যাওয়া
* মুখের ভিতর ও চোখের সাদা অংশে রক্তের ছাপ দেখা যাওয়া।
* প্রচন্ড ক্লান্তি ও দুর্বলতা অনুভব করা
* লিভার সামান্য বড় হয়ে যাওয়া।
* রক্তের প্লাটিলেট কমে যাওয়া
কিন্তু ভাইরাস এর গঠন গত পরিবর্তন হওয়াতে কোনো কোনো ক্ষেত্রে এই সকল লক্ষণ ছাড়াও কোনো ব্যক্তি ডেঙ্গু আক্রান্ত হতে পারে। সাধারণত এডিস মশার কারণে ডেঙ্গু হলেও অন্যান্য সাধারণ মশারাও ডেঙ্গু রোগ ছড়াতে সাহায্য করে। ডেঙ্গু আক্রান্ত ব্যক্তিকে যদি কোনো সাধারণ মশাও কামড়ায় তবে সেই মশাও ডেঙ্গু বাহি হয়ে পড়ে।
চলতি বছরে দক্ষিণ এশিয়া ও দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার বিশাল অংশ জুড়ে ছড়িয়ে পড়েছে এই ডেঙ্গু ভাইরাস। ইন্দোনেশিয়া , ফিলিপাইন, থাইল্যান্ড সহ কয়েকটি দেশে ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ এর বাইরে চলে যাওয়ায় স্বাস্থ্য ক্ষেত্রে জরুরি অবস্থা জারী করেছে দেশগুলো। ডেঙ্গু রোগের সাধারণ লক্ষণ অন্য সব ভাইরাস রোগের মত হলেও এবার ডেঙ্গু রোগের লক্ষণ পাল্টেছে। এর কারণ খুঁজতে গিয়ে বিশেষজ্ঞরা দুই দলে বিভক্ত হয়ে পড়েছে, এক দল মনে করছে ডেঙ্গু ভাইরাস-এ অভিযোজন ঘটার ফলে একটি উপজাতের সৃস্টি হয়েছে, আর কোনো ভাইরাস-এর দেহে অভিযোজন ঘটলে মহামারীর আশংকা থাকে। অন্য দল মনে করছে, এডিস মশার অধিক প্রজননের কারণেই দ্রুত এই রোগের জীবাণু ছড়িয়ে পড়ছে।
ডেঙ্গু আক্রান্ত ব্যক্তিরা সাধারণত এক সপ্তাহ থেকে দশ দিনের মধ্যেই সুস্থ হয়ে উঠে , কিন্তু ডেঙ্গু প্রভাবিত অন্য কোনো উপসর্গ দেখা দিলে রোগীর অবস্থার অবনতি হয়, এমনকি ডেঙ্গু রোগের জীবাণু প্রাণঘাতী ও হতে পারে। ডেঙ্গু রোগ হলে যে কারণে সব চেয়ে বেশি রোগী মারা যায় তা হলো , রক্তে প্লাটিলেট কমে যাওয়া। প্লাটিলেট হলো রক্তের এক ধরণের ক্ষুদ্র কণিকা বা অনুচক্রিকা , প্লাটিলেট রক্ত জমাট বাঁধতে ও রক্ত ক্ষরণ বন্ধ করতে সাহায্য করে। রক্তে প্লাটিলেট এর মাত্রা কমে গেলে রক্ত ক্ষরণের ঝুঁকি দেখা যায়। একজন সুস্থ মানুষের প্রতি ১০০মিলি লিটার রক্তে প্লাটিলেটের হার প্রায় দেড় লক্ষ থেকে ৪লক্ষ , আর প্লাটিলেটের পরিমান ২০ হাজারের নিচে নেমে এলে কোনো প্রকার আঘাত ছাড়াই রক্ত ক্ষরণ হতে পারে। ডেঙ্গু রোগের কোনো প্রতিষেধক নেই, মশার বংশ বৃদ্ধি রোধ করে এই রোগের মাত্রা কমানো যেতে পারে । বর্তমানে ৫ধরণের ডেঙ্গু ভ্যাকসিন নিয়ে গবেষণা চলছে, তার মধ্যে দুটি প্রায় শেষ পর্যায়। তবে ভ্যাকসিন আবিষ্কারের আগে ডেঙ্গু প্রতিরোধ করতে হলে এডিস মশা নিয়ন্ত্রণ করা ছাড়া আর কোনো উপায় নেই।
এই মশা ঘন জঙ্গলে নয় বরং লোকালয়ের বাস করে, বাড়ির আসে-পাশে ছড়িয়ে থাকা আবদ্ধ জলে এরা বংশ বিস্তার করে, ফুলের টব, ডাবের খোসা, রাস্তার সীমিত জলাবদ্ধতাসহ, গোসল খানার জমে থাকা পানিতে এডিস মশা জন্ম নেয়। সেজন্য বাড়ির আসে-পাশে পরিষ্কার রাখতে হবে , কোথাও যেন বৃস্টির পানি জমে না থাকে সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে , গোসল খানায় কোনো পানি ৫ দিনের বেশি জমিয়ে রাখা যাবে না। ডেঙ্গু আক্রান্ত ব্যক্তিদের জন্য কিছু বিশেষজ্ঞ পরামর্শ হলো ---
* ডেঙ্গু ভালো না হওয়া পর্যন্ত রোগীকে বিশ্রামে থাকতে হবে।
* পানি, শরবত, ডাবের পানি বা অন্যান্য তরল খাবার গ্রহণ করতে হবে।
* খাদ্যগ্রহনে অসুবিধা হলে, শিরা পথে স্যালাইন গ্রহণ করতে হবে।
* জ্বর কমাতে প্যারাসিটামল জাতীয় ওষুধ দেয়া যেতে পারে।
* কিন্তু ব্যথা কমাতে পেইন কিলার বা ব্যথানাশক ওষুধ দেয়া যাবে না , এতে রক্ত ক্ষরণের ঝুঁকি বেড়ে যায়।
ডেঙ্গু সংক্রমণ থেকে রক্ষা পেতে কিছু বিষয়ে সতর্ক থাকতে হবে ----
# এডিস মশা সাধারণত দিনের বেলা কামড়ায় , তবে রাতে উজ্জ্বল আলোতেও কামড়াতে পারে।
# শরীরের অনাবৃত অংশ যথাসম্ভব ঢেকে রাখতে হবে।
# দিনে বা রাতে কখনোই মশারি ছাড়া ঘুমানো উচিত নয়।
# জ্বর হলে কখনোই নিজে নিজে চিকিৎসা করা উচিত নয়।
# ভিটামিন সি জাতীয় দেশি ফল বেশি করে খাওয়া উচিত।
# ধূমপানের অভ্যাস ত্যাগ করা উচিত।
অতীতে ভিয়েতনাম , অস্ট্রেলিয়া , ব্রাজিল , ইন্দোনেশিয়ার মত দেশ গুলো এডিস মশা নিয়ন্ত্রণে সফলতা পেয়েছে। আমাদের দেশেও সে ব্যাপারে সম্ভাব্যতা যাচাই করে স্থায়ী সমাধানের দিকে যেতে হবে। তবে প্রতিটি নাগরিক সচেতন না হলে কোন সরকারের পক্ষে একক ভাবে এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করা সম্ভব নয়।
No comments:
Post a Comment