ভারতীয়
উপমহাদেশে হিন্দু মুসলিম সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার অত্যন্ত বিতর্কিত এক অধ্যায় হচ্ছে
বাবরি মসজিদ।
ভারতের
উত্তর প্রদেশের ফৈজাবাদ জেলার অযোধ্যা শহরে ছিল বাবরি
মসজিদের অবস্থান। মুঘল সম্রাট বাবরের
আদেশে তার সেনাপতি মীর
বাকি ১৫২৮ সালে এই
মসজিদ মির্মান করেন। হিন্দুদের বিশ্বাসমতে বাবরি মসজিদটি যে জায়গায় নির্মাণ
করা হয়েছিল সেই জায়গাটি ছিল
হিন্দু ধর্মের অবতার রামচন্দ্রের জন্মস্থান এবং হিন্দুদের দাবি
অতীতের রামমন্দির ভেঙে তার উপর
বাবরি মসজিদ তৈরী করা হয়েছে।
এই বিষয়টি নিয়ে ১৮০০ শতক
থেকেই হিন্দু এবং মুসলিম সম্প্রদায়ের
মধ্যে বিতর্ক চলে আসছে। ১৯৯২
সালের ৬ই ডিসেম্বর হিন্দু
মৌলবাদীরা এই মসজিদে আক্রমণ
করে সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস করে ফেলে। এর
ফলশ্রুতিতে সমগ্র ভারতজুড়ে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার সৃষ্টি হয়। সেই দাঙ্গায় প্রায়
২ হাজারেরও অধিক লোক মারা
যায়, যাদের বেশিরভাগই ছিল মুসলিম।
বাবরি
মসজিদের এই হামলা ও
ধ্বংসের পিছনে জড়িয়ে আছে কয়েকশ বছরের
সাম্প্রদায়িক ক্ষোভ এবং একাধিক ভারতীয়
হিন্দুত্ববাদী সংঘটনের ঘৃণ্য রাজনৈতিক ষড়যন্ত্র। ১৮৫৩ সালে প্রথমবারের
মতো বাবরি মসজিদকে কেন্দ্র করে সহিংসতার ঘটনা
ঘটে। তৎকালীন ব্রিটিশ প্রশাসন মসজিদের আঙিনায় বেষ্টনী তৈরী করে হিন্দু
ও মুসলমানদের উপাসনার জায়গা আলাদা করে দেয়। সেসময়
বেষ্টনীর ভিতরের চত্বর মুসলিমদের জন্য এবং বাইরের
চত্বর হিন্দুদের জন্য নির্ধারিত হয়।
এরপর দীর্ঘদিন যাবৎ বাবরি মসজিদ
কেন্দ্রিক সাম্প্রদায়িক অস্থিরতা কিছুটা স্তমিত ছিল।
বিগত
শতকের শুরুর দিকে বাবরি মসজিদ
নতুন করে একাধিক কলহের
জন্ম দেয়। ১৯৪৯ সালে হিন্দু
মৌলবাদীরা গোপনে মসজিদের ভিতর একটি রামমূর্তি
স্থাপন করে, মুসলিমরা এর
প্রতিবাদ জানায় এবং হিন্দু মুসলিম
উভয়ই একে অপরের বিরুদ্ধে
মামলা করে। সেই পরিস্থিতিতে দাঙ্গা
ঠেকাতে ভারত সরকার পুরো
মসজিদটিকেই সিলগালা করে দেয়। তখন
মসজিদ আঙিনায় প্রবেশাধিকার পাওয়ার জন্য হিন্দু মুসলিম
উভয়ই আদালতের দ্বারস্থ হয়। পরবর্তীতে ১৯৮৪ সালে বিশ্ব
হিন্দু পরিষদ রামের জন্মস্থান উদ্ধার এবং তার সম্মান
প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে একটি কমিটি গঠন
করে। হিন্দুদের এই পদক্ষেপে নেতৃত্ব
দেয় তৎকালীন বিজেপি নেতা ও পরবর্তী
সময়ে ভারতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী লাল কৃষ্ণ আদভানি।
১৯৮৬ সালে বিতর্কিত মসজিদের
দরজা হিন্দুদের জন্য খুলে দেয়
জেলা বিচারক। মুসলিমরা এর প্রতিবাদে বাবরি
মসজিদ অ্যাকশন কমিটি গঠন করে। ১৯৮৯
সালে বিশ্ব হিন্দু পরিষদ মসজিদ সংলগ্ন জায়গায় রামমন্দিরের ভিত্তি প্রস্থর স্থাপন করে নতুন প্রচারণা
শুরু করে। এরপর ১৯৯০
সালে বিশ্ব হিন্দু পরিষদের কর্মীরা মসজিদের আংশিক ক্ষতি সাধন করে, তখন
রাষ্ট্রীয়ভাবে আলোচনার মাধ্যমে বিতর্ক সমাধানের চেষ্টা করা হলেও হিন্দুত্ববাদীরা
সে প্রয়াস নস্যাৎ করে দেয়। অবশেষে
১৯৯২ সালের ৬ই ডিসেম্বর বিশ্ব
হিন্দু পরিষদ, ভারতীয় জনতা পার্টি ও
শিব সেনা সমর্থকেরা বাবরি
মসজিদে আক্রমণ চালিয়ে সম্পূর্ণ মসজিদটি ভেঙে ফেলে। বাবরি
মসজিদ ধ্বংসের সেই ঘৃণ্য ঘটনাকে
উন্মত্ত জনতার স্বতঃফূর্ত ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ হিসেবে দেখানো হলেও এর পিছনে
ছিল হিন্দু উগ্রবাদীদের দীর্ঘদিনের নীলনকশা। সেদিন বিশ্ব হিন্দু পরিষদ, ভারতীয় জনতা পার্টি ও
শিব সেনার প্রায় দেড় লক্ষ কর
সেবক একটি শোভাযাত্রা বের
করে। সেই শোভাযাত্রা বাবরি
মসজিদ প্রাঙ্গণে আয়োজিত এক রাজনৈতিক সমাবেশে এসে শেষ হয়। সেদিন
দুপুর ১২ টা পর্যন্ত
সেই সমাবেশ চলার পর কয়েকজন
কর সেবক বাবরি মসজিদের
গম্বুজের উপর উঠে যায়।
এরপর সহিংস হিন্দু জঙ্গিরা পূর্বপরিকল্পনা অনুযায়ী ষোড়শ শতকের এই
মসজিদটিকে ধূলিসাৎ করে দেয়। এতবড়ো
একটি স্থাপনা সাধারণ বিক্ষুদ্ধ জনতার পক্ষে ধ্বংস করা কিছুতেই সম্ভব
না। পরবর্তীতে অনুসন্ধানে দেখা যায় বিশ্ব
হিন্দু পরিষদ ও বিজেপির বেশ
কিছু নেতা সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা
সৃষ্টির নীলনকশার পিছনে জড়িত।
বাবরি
মসজিদ ভাঙার পরবর্তী কয়েকমাসে অযোধ্যাসহ সমগ্র ভারতজুড়ে বহু মুসলিমকে হত্যা
করে তাদের ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দেয়া হয়। বাবরি
মসজিদ ধ্বংসের তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় প্রায় ২০০০ এবং দীর্ঘমেয়াদী
প্রতিক্রিয়ায় আরো প্রায় হাজারখানেক
লোক নিহত হয়। এছাড়া
এই ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে পাকিস্তান এবং বাংলাদেশের হিন্দু
সম্প্রদায়ও সাম্প্রদায়িক সহিংসতার শিকার হয়েছিল। লাল কৃষ্ণ আদভানি,
মুরলি মনোহর যোশী, উমা ভারতীসহ এই
ঘটনায় জড়িত অন্যান্য রাজনৈতিক
নেতারা মুসলিম বিরোধী মানসিকতাকে কাজে লাগিয়ে বিপুল
সংখ্যক হিন্দু ভোটারকে বিজেপির ভোট ব্যাংকে পরিণত
করে। এর সুফল তারা
পরবর্তী নির্বাচনে হাতেনাতে পায় , লোকসভায় অধিক সংখ্যক আসন
ও উত্তর প্রদেশ বিধান সভায় সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জনের
মাধ্যমে।
২০০৯
সালে লিবারহান কমিশনের প্রতিবেদনে উঠে আসে যে,
বাবরি মসজিদ ধ্বংসের সাথে জড়িত ৬৮
জনের অধিকাংশ জনই ছিল বিজেপি
নেতা। তাছাড়া প্রতিবেদনটিতে তৎকালীন উত্তর প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী কল্যাণ সিংয়েরও সমালোচনা করা হয়, কারণ
ইমারতটি ভাঙার সময় অযোধ্যার পুলিশ
ও প্রশাসনের নিষ্ক্রিয় ভূমিকা ছিল চোখে পড়ার
মতো। উপরের মহলের ইশারা ছাড়া পুলিশের এতো
বড় অবহেলা কিছুতেই সম্ভব নয়।
Former UP CM Kalyan Singh
২০০৫
সালে ভারতীয় সাবেক গোয়েন্দা প্রধান মলয় কৃষ্ণ ধর
দাবি করেন যে , বিজেপি
(BJP) , ভিএইচপি (VHP) এবং আরএসএস (RSS) নেতারা
ঘটনাটি ঘটার ১০ মাস
পূর্বেই বাবরি মসজিদ ভাঙার পরিকল্পনা করেছিল। বাবরি মসজিদ ধ্বংসের রেশ ধরেই পরবর্তী
সময়ে বেশ কিছু দাঙ্গা
ও হামলার ঘটনা ঘটে। ১৯৯২
সালের ডিসেম্বর ও ১৯৯৩ সালের
জানুয়ারী মাসে বোম্বে দাঙ্গা
সংঘটিত হওয়ার ক্ষেত্রে শিব সেনা গুরুত্বপূর্ণ
ভূমিকা রেখেছিলো। সেই দাঙ্গায় প্রায়
৯০০ জন নিহত হয়েছিল
এবং প্রায় ৯০০০ কোটি ভারতীয়
রুপির সম্পদ বিনষ্ট হয়। এছাড়া ইন্ডিয়ান
মুজাহিদিনের মতো সন্ত্রাসী সংঘটন
বাবরি মসজিদ ধ্বংসকে তাদের সন্ত্রাসী হামলার কারণ হিসেবে উল্লেখ
করেন।
ভারতীয়
আইন অনুযায়ী হিন্দু দেবতা আদালতে অভিযোগ দায়ের করতে পারে এবং
হিন্দু দেবতার বিরুদ্ধেও আইনি লড়াই চালানো
যায়। অযোধ্যার ভগবান রামকে শিশুরূপে মানা হয়। রামের
এই শিশুরূপ আইন অনুযায়ী নাবালক,
আর তাই অযোধ্যার মামলায়
রামের প্রতিনিধিত্ব করেন বিশ্ব হিন্দু
পরিষদের নেতা ত্রিলোকী নাথ
পান্ডে। এছাড়া এই মামলায় হিন্দুদের
আরেকটি অংশ হলো নির্মোহী
আখারা নামের একটি গোষ্ঠী এবং
এদের বিপক্ষে মুসলিমদের হয়ে মামলা লড়েছে
সুন্নি ওয়াকফ বোর্ড। ২০০২ সালের পর
থেকে বাবরি মসজিদ সম্পর্কিত মামলায় নানা রকমের জটিলতা
দেখা যায়।
আদালতের
নির্দেশে জরিপ চালিয়ে ভারতীয়
পুরাতাত্ত্বিকবিদরা
জানিয়েছিল, এই মসজিদের তলায়
একটি প্রাচীন কাঠামোর সন্ধান পাওয়া গেছে কিন্তু সেই
প্রাচীন কাঠামো কোনো মন্দিরের অংশ
কিনা তার কোনো প্রমান
পাওয়া যায় নি। সুপ্রিম
কোর্ট নিজেও মেনে নিয়েছে যে,
পূর্বের কোনো মন্দিরকে ভেঙে
বাবরি মসজিদ তৈরী করা হয়েছিল
বলে যেই অভিযোগ রয়েছে
তা কোনো ভাবেই প্রমাণিত
নয়। তখন ২০১০ সালে
এলাহাবাদ হাই কোর্ট রায়
দেন যে , স্থানটির নিয়ন্ত্রণ
ভাগাভাগি করে দেয়া উচিত।
কোর্টের রায় অনুযায়ী তিন
ভাগের এক ভাগ মুসলমানদের,
এক ভাগ হিন্দুদের এবং
বাকি এক ভাগ নির্মোহী
আখারা গোষ্ঠীর কাছে দেয়া হয়।
সেই রায়ের বিরুদ্ধে হিন্দু এবং মুসলিম দুই
পক্ষই আপিল করলে সুপ্রিম
কোর্ট হাই কোর্টের পূর্ববর্তী
রায়কে বাতিল করে। অবশেষে ২০১৯
সালের ৯ই নভেম্বর বিতর্কিত
পুরো জায়গাটি জুড়ে মন্দির নির্মাণ
করার পক্ষেই চূড়ান্ত রায় ঘোষণা করা
হয় এবং মসজিদ নির্মাণের
জন্য সুন্নি ওয়াকফ বোর্ডকে অযোধ্যায় বিকল্প জমি বরাদ্ধ করা
হয় । সুপ্রিম কোর্ট একটি দেশের সর্বোচ্চ
আদালত, সেই আদালত কোনো
রায় দিলে সেই রায়
মেনে নেয়া ছাড়া আর
কোনো উপায় থাকে না।
কিন্তু অতীতে আদালত মসজিদ ভাঙাকে গুরুতর অপরাধ হিসেবে বিবেচনা করলেও আবার কিসের ভিত্তিতে
সেই অপরাধীদের পক্ষেই চূড়ান্ত রায় ঘোষণা হলো
বিষয়টি অনেকেরই বোধগম্য নয়।
No comments:
Post a Comment