প্রশান্ত মহাসাগরের মাঝে ভেসে থাকা খুবই ছোট একটি দেশ নাউরু। মাত্র ২১ বর্গ কিলোমিটার এলাকা জুড়ে থাকা এই দেশটি ভ্যাটিকান সিটি এবং মোনাকোর পর বিশ্বের ৩য় ক্ষুদ্রতম রাষ্ট্র। এর জনসংখ্যাও বেশ সীমিত। মাত্র ১১ হাজার আদিবাসী নিয়ে চলছে এই দেশটি। চলছে বলা সহজ হলেও, বাস্তব দৃশ্য পুরোপুরি ভিন্ন। বর্তমানে নাউরুর না আছে কোনো আবাদি জমি, না আছে এখানকার জনগণের কোনো নিশ্চিন্ত জীবন। যেই নাউরুকে একসময় প্রশান্ত মহাসাগরের কুয়েত বলা হতো, সেই নাউরু কিনা এখন অন্য রাষ্ট্রের কাছে হাত পেতে চলে।
কয়েক মিলিয়ন বছর ধরে বিভিন্ন ধরণের সামুদ্রিক প্রাণীর অভয়ারণ্য ছিল প্রশান্ত মহাসাগরের মাঝে এই নাউরু অঞ্চলটি। তাদের ফেলে যাওয়া বর্জ্য কয়েক মিলিয়ন বছর ধরে জমতে জমতে উৎকৃষ্ট মানের ফসফটের টিলায় পরিণত হয়। পরবর্তীকালে এই ফসফটের টিলা নাউরুর জন্য স্বর্ণের খনি হয়ে ধরা দেয়। ফসফেট কৃষিকাজের জন্য অত্যন্ত প্রয়োজনীয় একটি উপাদান এবং নাউরুতে যেসকল ফসফেট পাওয়া যেত সেসব ছিল পৃথিবীতে সর্বোৎকৃষ্ট মানের ফসফেট।
এখান থেকে তারা ফসফেট উত্তোলন করতে থাকে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে জার্মানরা পরাজিত হলে ব্রিটিশ ফসফেট কমিশন নামে নাউরু থেকে ফসফেট উত্তোলন চলতে থাকে, আর এর সুবিধা নেয় ব্রিটেন, অস্ট্রেলিয়া এবং নিউজিল্যান্ড। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধেও অবস্থা প্রায় একই ছিল। ১৯৬৮ সালে নাউরু স্বাধীনতা লাভের পরও দৃশ্যপট প্রায় একই থাকে। পরিবর্তন বলতে ব্রিটিশ ফসফেট কমিশন নাম পরিবর্তন করে নাউরু ফসফেট কর্পোরেশন নাম দিয়ে তারা পুরোদমে ফসফেট উত্তোলন চালাতে থাকে। আর সেই ফসফেট বিক্রি করতে থাকে পশ্চিমা বিশ্বের কাছে। সহজেই নাউরু সরকারের কাছে আসতে থাকে বিপুল পরিমান অর্থ।
১৯৭৫ সালে নাউরুর সরকারি ব্যাংকে জমা হয় ২৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। স্বাধীনতার পর এক যুগের অর্ধেক সময়ে কোনো রাষ্ট্রের এত বিপুল পরিমান অর্থের মালিক হওয়া বিরল। আর সে সময় নাউরুর জনসংখ্যা ছিল মাত্র ৭০০০ এর কাছাকাছি। নাউরুর জনগণের মাথাপিছু আয় এত বেশি ছিল যে, তাদের সামনে একমাত্র ধনী রাষ্ট্র ছিলো কুয়েত। নাউরুকে তখন বলা হতো প্যাসিফিকের কুয়েত। নাউরুর এই বিপুল পরিমান অর্থ দিয়ে তাদের পরবর্তী কয়েক প্রজন্মকে আরামেই খাইয়ে পরিয়ে রাখা যেতো। কিন্তু তাদের এই অর্থ দেশের উন্নয়নের জন্য খরচ করা ছিল অত্যন্ত জরুরি। উন্নত চিকিৎসা, উচ্চ শিক্ষা, মানসম্মত বাসস্থান এসব কাজে খরচ করার জন্য এই অর্থ ছিল যথেষ্ট। কিন্তু নাউরু কর্তৃপক্ষের কাছে অন্যরকম পরিকল্পনা ছিলো। তারা দামি বাড়ি, বিলাসবহুল হোটেল এবং গলফ কোর্ট বানায়। নাউরু কর্তৃপক্ষ এমনভাবে টাকা উড়াচ্ছিলো যেন তা কোনোদিনই শেষ হবে না। তারা একটি বিমানবন্দর বানায় যার উদ্দেশ্য ছিলো পশ্চিমা দেশগুলো থেকে খাদ্য আমদানি করা। নিজের দেশে খাদ্য উৎপাদন করার চেয়ে তারা বহিঃদেশের থেকে খাদ্য আনার দিকেই তারা মনোযোগ দিতে থাকে, সেজন্য তারা সাতটি বোয়িং বিমান কেনে, যা এক সাথে নাউরুর ১০ শতাংশ জনগণ বহন করতে সক্ষম। তাদের এই বিলাসিতা যেন শেষ হবার নয়। সবকিছু এক সাথে দেখভাল করার জন্য তারা একটি নাউরু ট্রাস্ট গঠন করে, কিন্তু শর্ষের মধ্যে ভূত থাকলে যা হয়। অব্যস্থাপনা, দুর্নীতি এবং অবাস্তব পরিকল্পনা সবকিছু নাউরুকে নিঃস্ব করে দিতে শুরু করে। সরকারি লোকজন রাষ্ট্রের টাকায় বিদেশে বিলাসবহুল জীবনযাপন করতে শুরু করে। আমেরিকা , ফিজি, লন্ডন এবং অস্ট্রেলিয়ার মতো দেশগুলোতে তৈরী করে নিজেদের বিলাসবহুল হোটেল। এর ফলে তারা প্রচুর পরিমান অর্থ পাচার করতে থাকে।
কিন্তু তাদের এই ফসফেটের সম্পদ তো একসময় ফুরিয়ে আসবে, হলোও তাই। ফসফেট রপ্তানি ছাড়া যেহেতু নাউরুর আর কোনো রাষ্ট্রীয় উপার্জন নেই এবং রাষ্ট্রীয় কোষাগারও ফাঁকা হয়ে পড়েছে তাই নাউরু সরকার এখন অন্যান্য রাষ্ট্রের কাছে হাত পাততে বাধ্য হলো। অন্য রাষ্টের কাছ থেকে তারা অর্থ ধার নিয়ে রাষ্ট্র চালাতে থাকে। এরপর আরো নানা ধরণের কেলেঙ্কারিতে জড়িয়ে পড়ে নাউরু। বর্তমান নাউরুর দিকে তাকালে দেখা যাবে সেখানে ৭০% জমি আছে যেখানে কোনো ধরণের চাষাবাদ সম্ভব না সেই সাথে নিন্মমানের খাবার এবং নানা রোগে ভুগতে থাকা জনগণ। নাউরুর ৯৭% পুরুষ এবং ৯৩% নারী স্থুলতার শিকার। কিডনি বিকল এবং হৃদরোগ সেখানে খুবই স্বাভাবিক, সেই সাথে নাউরুর ৯০% নাগরিকই বেকার। এক সময় নাউরুর বিশাল প্রতিপত্তির মালিক নাউরুর করুণ অবস্থা আমাদের মনে করিয়ে দেয় রাষ্ট্র পরিচালনায় সর্বদা সচেতন থাকা দরকার এবং দুর্নীতির ফলাফল হতে পারে এরকম মারাত্মক ভয়াবহ।
No comments:
Post a Comment